সুন্দরবনের বাওয়ালিদের জীবনকথা
মানছুরা আক্তার আঁখি
জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ অপার সৌন্দর্যমন্ডিত ম্যানগ্রোভ বন-সুন্দরবন। ১০হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই বনের একটা বিশাল আয়তন বাংলাদেশের অর্ন্তগত। বাংলাদেশের দক্ষিন ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত।
প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং হিংস্র প্রাণীর সাথে লড়াই করে প্রতিনিয়ত টিকে থাকে এই অঞ্চলের মানুষ। এই অঞ্চলে নানা শ্রেণির পেশার মানুষ বাস করে। তাদের মধ্যে এই অঞ্চলের একটা বিশেষ পেশার মানুষ হলো-বাওয়ালি।
বাওয়ালি হলো সেসব মানুষ যারা গহীন বন থেকে গোলপাতা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা গভীর বনে গিয়ে কাঠ কাটে এবং গোলপাতা সংগ্রহ করে। এই কাজের সময় এদেরকে নানা হিংস্র প্রাণী (যেমন বাঘ,বিষাক্ত কীটপতঙ্গ) মোকাবিলা করতে হয়।
পূর্বে এই পেশায় নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলেও বর্তমানে এ সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে।
বরিশাল জেলার স্বরুপকাঠি ইউনিয়ন এর অর্ন্তগত সোহাগদল, বর্ষাকাঠি, বলদিয়া, সুঠিয়াকাঠি ও বলিহারির লোকেরাই এই পেশায় বেশি দক্ষ।স্বরুপকাঠির ৮০% লোকই এই পেশার উপর নির্ভরশীল। এছাড়া খুলনার দক্ষিনাঞ্চল ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও পাথরঘাটায়ও এই পেশায় নিয়োজিত লোকের বাস।
নভেম্বর -জানুয়ারি এই তিন মাস বাওয়ালিরা গভীর বনে গিয়ে গোলপাতা ও কাঠ সংগ্রহ করে। এসময় এরা বাদায়(জঙ্গলপূর্ণ অঞ্চল) অবস্থান করে। বাদায় এরা টোঙ্গ(গাছের উপরে লতা/পাতা আর ডাল দিয়ে তৈরিকৃত ঘর) নামক বাসা তৈরি করে যা ভূমি থেকে ৬ ফুট উপরে তৈরি করা হয়। এর এক-তৃতীয়াংশ হলো রান্না করার স্থান।রান্নার কাজে এরা টোঙ্গে ১-২ জন রাখে।
বাঘসহ সকল হিস্র প্রাণীর কবল থেকে বাঁচতে এরা এমন অবস্থান বেঁছে নেয়। এরা ঘরে হেঁতাল নামক একধরনের গাছের ডাল/পাতা রাখে যা থাকলে ঘরে কোন সাপ আসতে পারেনা। এতে টোঙ্গ এর লোকেরা নিরাপদ থাকে। গোলপাতা সংগ্রহকালীন সময় এরা প্রতিদিন দল বেঁধে বনের ভীতরে প্রবেশ করে। এই সময় কখনো কখনো বাওয়ালিরা বাঘের কবলে পড়ে প্রাণ হারায় বা ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ বেঁচেও যায় চরম আহত হয়ে। তবে কেউ বাঘের কবলে পড়লে সে যদি মরে যায় বা আহত হয় তাহলে মালিকপক্ষ থেকে কিছু পরিমান(৪-১০ হাজার) আর্থিক সাহায্য আসে তার পরিমান অতি নগন্য। এছাড়া সরকার থেকে ও কিছু আর্থিক সাহায্য আক্রান্ত পরিবারকে দেওয়া হয়।
এছাড়া পূর্বে টোঙে অবস্থানকালে বাওয়ালি রা ডাকাত দলের শিকার হতো। এই সময় এরা নির্দিষ্ট পরিমান মোটা অংকের টাকা দাবি করতো। এতে বাওয়ালিরা টাকা দিতে অপরাগত হলে ডাকাতরা টোঙের একজনকে ধরে নিয়ে যেত ও সময়সীমা বেঁধে দিত। এই সময়ের মধ্যে এরা দাবিকৃত টাকা না পেলে সে আটককৃত ব্যাক্তিকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিত বা আগুনে পুড়িয়ে মারতো।
বর্তমানে এই বনদস্যুদের উৎপাত আরো বেড়ে যাচ্ছে।গোলপাতা সংগ্রহকালীন মৌসুমে তার নৌকা/ট্রলারসহ বাওয়ালিদের আটক করে ও চাঁদা দাবি করে। এ যেন জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ দশা।
বাওয়লিদের সংগ্রহকৃত গোলপাতা জাতীয় রাজস্ব আয়ে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গোলপাতার চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশিয় এই পন্য বিদেশে রপ্তানি করে কোটি টাকা আয় সম্ভব হচ্ছে।
ছাউনির কাজে গরিবের ঢেউটিন হিসেবে খ্যাত, গোলপাতার জুড়ি নেই। ঘরের ছাউনি হিসেবে গোলপাতার সর্বাধিক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া এটি দিয়ে কুঁড়ে ঘর, গোলাঘর, চালাঘর, গোশালা, কাঠগোলা, নৌকার ছাউনি, দোকান প্রভৃতির ছাউনির কাজ করা হয়। ছাউনি ছাড়াও রান্নার জ্বাল ধরাতে শুকনো পাতা ব্যবহার হয়। গোলপাতার সাহায্যে ছাতা, সানহ্যাট, রেইনকোর্ট, ঝুড়ি, মাদুর, থলে, খেলনা প্রভৃতি তৈরি করা হয়। গোলফল অনেকটা তালের মতো। কচি ফলের শাঁস খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই শাঁস খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। গোলগাছের মঞ্জুরী হতে রস সংগ্রহ করা হয় যাতে শতকরা প্রায় ১৮ ভাগ শর্করা বিদ্যমান। যা চিনি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়াও রস হতে ভিনিগার তৈরি হয়।
নানাবিধ প্রতিকূলতায় ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১১-০৯-৯০ সুন্দরবনের গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সে সময় বাওয়ালিরা বেকার হয়ে পড়ে।কিছু সংখ্যক বাওয়ালি ছাড়া অধিকাংশ বাওয়ালিরাই জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়। এতে করে পূর্বের তুলনায় বাওয়ালিদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
বর্তমানে প্রতিবছর নভেম্বর -জানুয়ারি মাসে গোলপাতা সংগ্রহে ও কাঠ কাটার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। এতে যেসব গাছ কাটতে হয় তাতে মার্ক করা হয় ও সেগুলো কাটার অনুমতি থাকে।
বর্তমানে নানাবিধ প্রতিকূলতা,হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ ও বনদস্যুর নিপিড়নে বাওয়ালিরা পূর্বের মত এই পেশায় আগ্রহী নয়। তারা এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে চায় না।
এই অবস্থা চলমান থাকলে দেশের রাজস্ব আয়ের একটি বিশেষ খাত অদূরে ভেঙে পড়বে। তাই
এই বিশেষ শ্রেণির পেশায় নিয়োজিত বাওয়ালিদের পর্যাপ্ত সাহায্য, নিরাপত্তা যদি প্রদান করা যায় তবে সুন্দরবনের এই অর্থকরি সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে একটি বিশেষ প্রভাব রাখবে বলে আশা করা যায়।