ধোঁয়াশা | মানছুরা আক্তার আঁখি

Share This:

ধোঁয়াশা
মানছুরা আক্তার আঁখি

ঘড়িতে রাত প্রায় ২টা।
অয়নের আচমকাই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।বাহিরে প্রবল বাতাস,ঝড়-তুফান।
কারেন্টও চলে গেলো।
-এই হলো এক জ্বালা।এদেশে একটু ঝড়-তুফানেই কারেন্ট চলে যায়।
অনেকটা বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো অয়ন।
চাকুরির সুবাদে সিলেটের একটা গ্রাম্য এলাকায় থাকতে হয় তাকে।
২৯ বছরের অয়ন অবিবাহিত। তাই তাকে একাই থাকতে হয়।এখানকার একটা বাংলোতে থাকে।অফিস থেকে খুব একটা দূরেও না। বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।

হঠাৎই দরজায় কেউ একটা ধাক্কা দিতে লাগলো।
-এত রাতে কে এলো! তাও এই ঝড় তুফানের রাতে! অয়নের কেমন জানি একটা লাগলো, সাথে একটু ভয়ও লাগলো।
কয়েক সেকেন্ডে ধাক্কানোর পরিমান আরো বাড়তে লাগলো।কিছুটা সাহস নিয়ে দরজাটা খুলেই ফেললো।
দরজা খুলতেই যেন বিদ্যুৎ গতিতে শরীরে রক্ত
চলাচল শুরু হলো।
-মেঘা,তুমি? বলেই তাকিয়ে রইলো।
-হ্যাঁ আমি।এতোটা চমকে উঠলে
আমায় দেখে?
-এতদিন পর তুমি? তাও এই ঝড় তুফানের রাতে! অয়ন একদমে প্রশ্নগুলো করলো।
-এভাবে প্রশ্ন করবে নাকি ভেতরে ডুকতে দিবে আমাকে?
মেঘার প্রশ্নে কিছুটা লজ্জা পেয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো অয়ন।
ঘরে ডুকেই মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলো সে।চার্জ লাইটে  আলো একদমই নেই।
-বাহ বেশ গুছিয়ে রেখেছো তো ঘরটা। কবে এতো গুছানো মানুষ হলে? আগে তো এমন দেখিনি!
অয়ন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো।কিছুক্ষন চুপ থেকে প্রশ্ন করেই ফেললো,
-এত রাতে আচমকায় কোথায় থেকে এসেছো? আর তোমার স্বামী কই? সে একা তোমাকে ছেড়ে দিলো?
প্রশ্নটা শুনে মেঘা মুচকি হাসতে শুরু করলো।
-আমার স্বামী?
-হ্যাঁ,তোমার! ২ বছর আগে আমাকে ছেড়ে যাকে বিয়ে করেছিলে, যার হাত ধরেছিলে সেই স্বামী।
-ওহ,আচ্ছা। তাই বলো।
এমন উত্তরে অয়ন একটু অবাকই হলো।মেঘা বিষয়টাকে এত হালকা করে নিলো কেন? আজ ২ বছর পর এই ঝড়ের রাতে বা কেন এলো ওর কাছে?
আচমকাই মেঘার প্রশ্নে তার স্বকীয়তা ফিরে এলো।
-বলি, একাই থাকো এখানে?
-হ্যাঁ,একাই থাকি।
-তো বিয়ে করোনি?
-নাহ।
-কেন?
-এতসব জেনে কি করবে তুমি? সংসার নিয়ে তো সুখেই আছো।
কথাটা শুনে মেঘা জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো।
অয়ন যতই দেখছে মেয়েটাকে ততই অবাক হচ্ছে। এত হেয়ালি করছে কেন!
-বলি আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।কিছু খাওয়ানো যাবে?
-ঘরে তো রান্না করা কিছু নাই, আচ্ছা আমি নুডলস রান্না করে দিচ্ছি।
-আরে থামো।আমি থাকতে তুমি কেন রান্না করবে? রান্না ঘরটা কোথায় দেখিয়ে দাও।
অয়ন আর কথা বাড়ালো না।ও জানে মেঘাকে। যা করবে বলেছে তো করবেই।
-তোমার রান্নাঘরটা তো বেশ বড়!
-হুম।
-নিজেই রান্না করে খাও?
-হুম।
-বাহ, বেশ ভালো।
রান্না করতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না।
দুজনেই বসার ঘরে গিয়ে বসলো।
মেঘা খুব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে অয়ন সেটা দেখছে।
কতদিন পর এভাবে সে মেঘাকে সামনে থেকে দেখছে।তাও সেই চিরচেনা রূপে।মেয়েটায় মধ্যে খুব বেশি মায়া আছে।যেটা দেখে সে প্রেমে পড়েছিলো।
কিন্ত ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি।সেদিন ছেড়ে যাওয়ার পর আর কোনদিন সে মেঘার সাথে যোগাযোগ করেনি।মেঘাও আর চেষ্টা করেনি।মাঝে মাঝে মন চাইতো পুরানো নাম্বারটাতে কল দিতে।কিন্ত কেন জানি আর পারতোনা।তবে শপথ করেছিলো বাকি জীবন মেঘার স্মৃতি নিয়েই বাঁচবে। আর কাউকে জড়াবে না।
-তুমি বিয়ে করোনি কেন?
প্রশ্ন শুনে অয়ন কোন উত্তর দিলো না। চুপ করে রইলো।
-তুমি কি এখনও আমার উপর রেগে আছো?
-নাহ।যাকে ভালোবাসা যায় তার উপর রাগ করা যায়না।
-ভালোবাসো এখনও আমাকে?
-জানিনা।
আসলেই অয়ন এখনও সেই আগের মতোই মেঘাকে ভালোবাসে।২টা বছর ওর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে।পরিবারের লোক অনেক চেষ্টা করেছে।কিন্ত পারেনি তার শপথ ভাঙাতে।
-আজকে তোমাকে অনেকগুলো সত্যি বলবো। আর তার জন্যই আমি এসেছি।
-কিসের সত্যি?
-অয়ন আমার যেদিন বিয়ের তারিখ ছিলো সেদিন বিয়ে হয়নি।
-মানে?
-হ্যাঁ।বিয়ের ২দিন আগে সন্ধ্যায় একটা পরিচিত ভাবীর জন্য রক্তের দরকার ছিলো।আমার রক্তের গ্রুপের সাথে তার গ্রুপের সাথে মিল ছিলো।সিজারিয়ান রোগী ছিলো।তাই ইমার্জেন্সি হওয়ায় কিছু না ভেবেই বের হয়ে গেলাম কাউকে কিছু না জানিয়ে।রক্ত দিয়ে হসপিটাল থেকে বের হতে হতে রাত ১১ টা বেজে গিয়েছিল। এদিকে ফোনে ও চার্জ ছিলো না।
রাস্তা খুব একটা গাড়ি পাওয়া যায় না ঐদিকে।
কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস এসে সামনে দাঁড়ায়।কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়।
এতটুকু বলে মেঘা থেকে যায়।
চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
অয়ন কি বলবে বুঝে উঠতে পারলোনা। চুপ করে রইলো।
মেঘা আবার বলতে শুরু করলো-
সেদিন জোর পূর্বক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ৩জন লোক আমাকে,,,,,,,,
অনেক আকুতি করেছিলাম। কিন্ত আমাকে ছাড়লোনা।
এরপর শুরু হয় আমাকে চুড়ান্ত কষ্ট দেওয়ার।
ওরা একজন আমার হাত-পা বেঁধে ফেলে। এরপর একটা ছুরি দিয়ে আমার ৪ হাত-পায়ের রগ কেটে ফেলে।জানো সে কি পরিমান যন্ত্রণা পেয়েছিলাম আমি। এরপর আমার সেই আর্তনাদ,চিৎকার ওদের ভয়ংকর হাসিতে বাতাসে মিলিয়ে গেলো।
রক্তের স্রোতে যেন ওদের সেদিন জয়ের নিশানা মিললো।
এবার আসলো আমাকে পৃথিবী থেকে বিদায় দেওয়ার পালা।
একজন লোক একটা ধারালো ছুরি নিয়ে আমার মাথার কাছে এসে বসলো।আবছা আলোতে আমি সে মানুষটাকে চিনতে পেরেছিলাম।কিন্ত গলা দিয়ে কেন শব্দ বের হচ্ছিলো না তখন। শেষ কথা এটাই ছিলো তার -অবশেষে আমি আমার প্রতিশোধ নিতে পারলাম।আর সাথে সাথেই আমার গলায় সেই ধারালো ছুরি চালিয়ে দেয়।
চিৎকার করারও কোন শক্তি ছিলোনা। তখন জানো শুধু মা,বাবা আর তোমার মুখটা খুব মনে পড়ছিলো।শেষবারের মতো তোমাদের দেখতে খুব মন চাই ছিলো।
-তার মানে তুমি বেঁচে নেই? অয়নের হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো আর প্রচন্ড ঘামতে লাগলো।
-নাহ।আমি সে রাতেই পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছিলাম।জানো সে লোকটি কে ছিলো?
-কে?
-আমার পাশের বাড়ির রানা।যে ছোটবেলা থেকেই আমাকে পছন্দ করতো।বিয়ে প্রস্তাব ও দিয়েছিলো কিন্ত বার বার প্রত্যাখান পাওয়ায় আর আমার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হওয়ায় সে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
আর তাই প্রতিশোধের নেশায় সে এভাবে আমায় মেরে ফেললো।আর তার পরেরদিন এসে সবাইকে বলেছিলো আমি পালিয়ে গেছিলাম।
যাতে আমার খোঁজ কেউ না নেয়। আর আমার লাশটা একজায়গায় দিনের পর দিন থেকে পরে পঁচে গিয়ে মাটিতে মিশে গিয়েছিলো।আজকে সে রাত।
আজ আমি কেন এসেছি জানো?
-কেনো?

-আমি চাই এই খারাপ লোক গুলোর শাস্তি হোক। আমার সব কষ্টের শাস্তি পাক ওরা। বলো তুমি দিবে?
-হ্যাঁ।আমি তোমার খুনের শাস্তি দিবো ওদের।যেভাবে যতটা কষ্ট দিয়েছে তোমাকে ততটাই তাদের ও প্রাপ্য।
-যেদিন ওদের শাস্তি পরিপূর্ণ হবে, সেদিন আমি আবার আসবো তোমার কাছে।
কথাগুলো শেষ হতেই কোথায় যেন মেঘা অদৃশ্য হয়ে গেলো।
ফজরের আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।ঝড় ও থেমে গেলো।
-তাহলে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলাম আমি? মেঘার কথাগুলো কি সত্যি? নাকি সবটাই স্বপ্ন? অয়নের মাথায় পুরো বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছে।
পরের দিন অফিসে গিয়ে ২দিনের ছুটি নিয়ে সে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিলো।এসেই যে স্থানের কথা মেঘা বলেছিলো অয়ন সেই স্থানে পুলিশকে নিয়ে গিয়েছিলো।
পুলিশ সেখান থেকে কিছু হাড় আর একটা আংটি খুঁজে পেলো।
আংটিটা দেখেই অয়ন চিনে ফেললো যে এইটা সেই আংটি যেটা সে মেঘাকে দিয়েছিলো।পুলিশ হাড়গুলো নিয়ে ডিএনএ টেষ্ট করে এবং নিশ্চিত হয় যে এইটা মেঘারই লাশ।
অয়ন রানার নামে থানায় ধর্ষন ও খুনের মামলা দায়ের করে।পুলিশ রানাকে ধরে নিয়ে যায়।প্রথমে স্বীকার না করলেও পরবর্তীতে রিমান্ডে দেওয়া হয়। সেখানে জিঙ্গাসাবাদে সে বাকি ২জনের নাম প্রকাশ করে ও এই ঘটনা স্বীকার করে।
মামলা আদালতে উঠে। কিছুদিন মামলা চলার পর ৩জনকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতদন্ডের রায় ঘোষণা করা হয়।
কিছুদিন পর,
রাত ২ টা।বাহিরে সেদিনের মতো আবার ঝড়-বৃষ্টি।
আজকে রাতেই খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হবে।
এতদিন পর মেঘার খুনিরা শাস্তি পাবে এইটা ভেবেই অয়নের শান্তি লাগছে।তবে কষ্টটাও তীব্র হচ্ছে ভেবে যে মানুষটাকে এতটা ভালোবাসে তার জীবনের শেষ পরিনতি এভাবে হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো টেরই পেলো না।
-অয়ন,আজ তুমি যেভাবে আমার খুনিদের শাস্তি দিতে সাহায্য করলে তাতে আমার সব কষ্ট শেষ হলো।
আচমকাই এমন কথায় অয়নের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।বুঝতে পারলো মেঘা কথা রেখেছে।

আজকের পর মেঘার আত্নার শান্তি হবে।
মেঘা বেঁচে থাকতে যা সে করতে পারেনি আজকে সব নর পিশাচদের শাস্তির ব্যবস্থা করে সে দায়িত্ব পালন করলো।
জানলা খুলে অয়ন আনমনে বাহিরের বৃষ্টির ফোঁটায় প্রশান্তির দৃষ্টি দিলো।

Loading...