একদিকে চীনা ঋণ, অন্যদিকে এক পরিবারের শাসন ‘বেসামাল শ্রীলঙ্কা’
অনলাইন ডেস্ক:
মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব এবং খাদ্য থেকে ওষুধ পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের ঘাটতি, সবমিলিয়ে অনেক শ্রীলঙ্কান বিদেশে উন্নত জীবনের আশায় নিজ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। সবার অবশ্য দেশ ছাড়ার সামর্থ্য নেই। জ্বালানি ঘাটতি, বিদ্যুৎ ঘাটতি এবং খাদ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে অগণিত শ্রীলঙ্কান এখন মূল পেশার বাইরে অন্যকিছু করতে বাধ্য হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, আমদানি করার মতো প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় শ্রীলঙ্কায় মারাত্মক জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। দেশটির পেট্রোল পাম্পগুলোর সামনে সারা দিনই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন হাজারো মানুষ। লাইনে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও এসেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী। জ্বালানি তেল আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুৎ সংকটে প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে কাগজ আমদানি করতে না পারায় স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে। অবস্থা এতোটাই শোচনীয় যে, কাগজের অভাবে কয়েকটি পত্রিকা নিজেদের প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। ওদিকে, মুদ্রাবিনিময় সংকটে আমদানি বিধিনিষেধ থাকায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকার যানবাহন আমদানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, প্রতিমাসে পাঁচ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের চা ইরানে রপ্তানি করে ধীরে ধীরে ইরানের কাছ থেকে কেনা আড়াইশ’ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি তেলের দাম শোধ করবে দেশটি।
লন্ডনভিত্তিক থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন বলছে, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে শ্রীলঙ্কা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়েছে। ঐতিহাসিকভাবে দুর্বল সরকারি অর্থব্যবস্থা, অসময়ে ট্যাক্স কাটছাঁট এবং দেশের অন্যতম আয়ের খাত পর্যটন শিল্পকে আঘাত করা করোনা মহামারি দেশটির অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এর ফলে, চরম মুদ্রা সংকট সৃষ্টি হয়েছে যার কারণে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হয়েছে। বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় খাদ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
অবশ্য মহামারি শুরুর আগেই শ্রীলঙ্কাকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং ধীর প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। সরকারি হিসাব মতে, গত দুই বছরে (করোনাকালে) দেশটির প্রায় ১৪০০ কোটি ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে ৩.২০ ডলার দৈনিক আয়ের উপর ভিত্তি করে হিসাব করা দরিদ্রদের সংখ্যা ২০২০ সালে আনুমানিক ৫ লাখেরও বেশি বা ১১.৭% বেড়েছে যা এর আগের বছর ছিল ৯.২%।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের নভেম্বরে সেটা এক বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে এবং এখন সেটা এক বিলিয়ন ডলারেরও নিচে নেমে আসায় অনেক অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করছেন দেশটি ঋণখেলাপি হওয়ার পথে।
গত প্রায় এক দশক ধরে সড়কপথ, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দরসহ শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ৫০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ দেয় চীন। সমালোচকরা বলছেন, ঋণের অর্থ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে খরচ করা হয়েছে, যেখান থেকে নেহায়েতই সামান্য পরিমাণ আয় হচ্ছে। বর্তমানে বহুল প্রচলিত চীনা “ডেবট ট্র?্যাপ ডিপ্লোম্যাসি” বা “ঋণের ফাঁদ” কথাটির বাস্তব উদাহরণ দিতে অনেকেই শ্রীলঙ্কার প্রসঙ্গ টানেন। চীনা বিনিয়োগে শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোটায় বৃহৎ আকারের বন্দর নির্মাণের প্রকল্প শুরু করে। কয়েকশ’ কোটি ডলারের ওই প্রকল্পে চীনা ঋণ এবং চীনা ঠিকাদারদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সারা বিশ্বেই এই প্রকল্প কতটা বাস্তবায়নযোগ্য সেটা ঘিরে বহু বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, এর ফলে শ্রীলঙ্কা ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপে জর্জরিত হয়ে পড়বে। সেই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা প্রমাণ করতেই যেন বছর পাঁচেক আগে শ্রীলঙ্কা আরও চীনা বিনিয়োগের বিনিময়ে বন্দরটির ৭০% নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না মার্চেন্টস কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য ছেড়ে দিতে সম্মত হয়।
এর বাইরেও আর্থিক বিপর্যয় মোকাবিলা করতে চীনের কাছ থেকে অতিরিক্ত আরও ১ বিলিয়ন ডলার ধার করে শ্রীলঙ্কা। অবশ্য, ২০১৪ সাল থেকেই ঋণের বোঝা বাড়তে শুরু করেছিল দেশটির। বর্তমানে পরিস্থিতিতে, এ বছর সব মিলিয়ে অন্তত ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শোধ করতেই হবে দেশটিকে।
ইউনিভার্সিটি অব কলম্বোর শিক্ষক এবং অর্থনীতির গবেষক উমেশ মোরামুদালি অবশ্য মনে করেন, চীনা ঋণের ফাঁদই যে শ্রীলঙ্কার এমন সংকটের মূল কারণ, সেটি ঠিক নয়। সমস্যার কারণ আরও গভীরে উল্লেখ করে তিনি দ্য ডিপ্লোম্যাটে লিখেছেন, শ্রীলঙ্কার সরকারি ঋণের মাত্র ১৪% চীনের কাছ থেকে নেওয়া। বিশ্ববাজারে সার্বভৌম বন্ড ছেড়ে নেওয়া হয়েছে ৩৬%। তার মতে, শ্রীলঙ্কার বর্তমান সমস্যা আসলে দশকের পর দশক ধরে আর্থিক খাতে সংস্কারের ব্যাপারে সরকারগুলোর উদাসীনতার পুঞ্জীভূত রূপ? করোনা মহামারির কারণে তা আরও জটিল রূপ ধারণ করেছে।
উমেশ মনে করেন, বর্তমান সমস্যার মূলে রয়েছে মারাত্মক ব্যালান্স অব পেমেন্ট সংকট, যা শ্রীলঙ্কা ২০২০ সালের শুরু থেকেই মোকাবিলা করে আসছে। করোনাকালে দেশটির অন্যতম আয়ের খাত পর্যটন থেকে শ্রীলঙ্কা বার্ষিক অন্তত ৪ বিলিয়ন ডলার করে হারিয়েছে (করোনার আগে শুধু পর্যটন এবং রেমিটেন্স খাত থেকেই শ্রীলঙ্কা ১২ বিলিয়ন ডলার আয় করতো)। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ব্যাপক করছাড়সহ (ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানো) বর্তমান সরকার গৃহীত বেশকিছু বেপরোয়া অর্থনৈতিক নীতি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাছ থেকে সহায়তা না নেওয়ার সরকারি একগুঁয়ে নীতিও এর পেছনে কাজ করেছে। আইএমএফ’র ঋণ নিলে দেশটির সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ অর্থনীতিতে আরও বেশকিছু সংস্কার কার্যক্রম চালাতে হবে। কর ছাড়ের সিদ্ধান্তটি যে ভুল ছিল তাও স্বীকার করতে হবে, যেটি সরকার করতে চাচ্ছে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের আত্মগরিমার প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে উমেশ লিখেছেন- “নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যবসাকে রক্ষা করার জন্য তাদের ট্যাক্স কাটছাঁটের সরকারি সিদ্ধান্ত এবং সরকারের ব্যাপক অহঙ্কারের কারণে আমরা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছি। এটা আমি কখনই ভুলবো না? আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার জন্য (তাদের) কখনই ক্ষমা করবো না। বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, পানি নেই, জ্বালানি নেই।”
যদিও অতি সমপ্রতি জানা গেছে, উদ্ধার পরিকল্পনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি আগামী মাসে শ্রীলঙ্কা বিশ্বব্যাংকের সহায়তাও চাইবে। আইএমএফ-এর ঋণ পেতে ইতিমধ্যেই ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
সুত্র: মানবজমিন অনলাইন